অনিন্দ্যসুন্দর চর কুকরি-মুকরি ও তারুয়া সমুদ্রসৈকত
হাবিব ওয়াহিদ
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ পিএম
তারুয়া সমুদ্রসৈকতে সূর্যাস্ত। ছবি : লেখক
জীবন অনেক সুন্দর, যদি তা সুন্দরভাবে উপভোগ করা যায়। হতাশায় নিমজ্জিত না থেকে নয়নাভিরাম প্রকৃতির সান্নিধ্যে একটা সূর্যাস্ত কাটানো মন্দ কী! ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড পুরোটাই যেন প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য। চর কুকরি-মুকরি ও তারুয়া সমুদ্রসৈকত যেখানে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ‘নেশাটা হোক ভ্রমণের, প্রেম হোক প্রকৃতির সঙ্গে’ এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে এবার আমার ভ্রমণ গন্তব্য ভোলা জেলার বেশ কিছু জায়গাÑ প্রশান্তি পার্ক, শেখ রাসেল শিশু ও বিনোদন পার্ক, ওয়াচ টাওয়ার, চর কুকরি-মুকরি, তারুয়া ভার্জিন সমুদ্রসৈকত এবং ঢালচর।
বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নে তারুয়া সমুদ্রসৈকতের অবস্থান। জেলা শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা এই চরে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। প্রশাসনিকভাবে এই জেলাকে ‘কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ’ নামেও অবহিত করা হয়। এই সমুদ্রসৈকতের নামের শেষে বিশেষণ জুড়ে দেওয়া হয় ‘ভার্জিন’। তারুয়া ভার্জিন সমুদ্রসৈকতের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এখানে পর্যটকের পদচারণা কম এবং কোলাহলমুক্ত সমুদ্রসৈকত। এটা এমন এক সমুদ্রসৈকত, যেখানে প্রকৃতি সৌন্দর্য ছড়িয়েছে আপন মনে। জোছনা রাতের আলোয় আমি এবং অভি ভাই আপন মনে তারুয়া সমুদ্রসৈকতে মৃদু শীতল হাওয়া গায়ে মেখে হাঁটছি। ভরা পূর্ণিমায় সমুদ্র এর আগেও দেখেছি, তবে এবার একটু বেশি উপভোগ্য মনে হচ্ছে। রয়েছে সুদৃশ্য ল্যান্ডিং স্টেশন । যেটা খানিকটা সমুদ্রের দিকে চলে গেছে। ল্যান্ডিং স্টেশনে উঠলাম। রাত প্রায় ১২টা শীতের মাত্রা বাড়ছে, তাই আলাপচারিতা বিরতি দিয়ে পাশের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ থেকে কিছু লাকড়ি সংগ্রহ করে ফায়ারিং করলাম, সঙ্গে ফানুস উড়ালাম। উষষ্ণতা অনুভবে সেদিনের মতো রাতকে বিদায় জানিয়ে ঘুমালাম। সকালের সমদ্র দেখার লক্ষ্যে খুব ভোরে উঠলাম। পুবের আকাশে সূর্যটা ডিমের কুসুমের ন্যায় উদিত হওয়ার দৃশ্যটা মুগ্ধতা ছড়াবে যে কারও মনে। সৈকতে অজস্র লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটিÑ কাছে গেলেই গর্তে লুকিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রস্নান হৈ-হুল্লোড় ও ভার্জিন সৈকতের আলিঙ্গনে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম মুহহৃর্তেই। ফেরার পথে শুঁটকিপল্লি ও ঢালচরে উঁকি মারলাম।
আমাদের ভ্রমণের শুরুটা হয়েছিল চরফ্যাসন ও চর কুকরি-মুকরি দিয়ে। ১০০ টাকা প্রবেশ মূল্যে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধুনিক ও সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার ‘জ্যাকব টাওয়ার’ পরিদর্শন করলাম। টাওয়ারে উপরিভাগে রয়েছে ‘রুফটফ স্ন্যাকস’ ও রয়েছে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দূরের দৃশ্য দেখার সুযোগ। ঘুরে দেখলাম শেখ রাসেল শিশু ও বিনোদন পার্ক।
জনশ্রতি রয়েছে, এই দ্বীপে একসময় প্রচুর ইঁদুর ও কুকুুরের বসবাস ছিল সেই থেকে এই চরের নামকরণ হয় চর কুকরি-মুকরি। কুকরি-মুকরিতে শীতের সকালে গ্রামীণ মেঠো পথে হাঁটছি... শিম গাছের ডগায় শিশিরের টলমল দৃশ্য; খুঁজে পেলাম প্রাণের ছন্দ ও অপার্থিব আনন্দ। কেওড়া বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলছি যেন কিছুটা সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের আবহ। সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার থেকে সমগ্র চর কুকরি-মুকরি অবলোকন করলাম। নারিকেল বাগানের দোলনায় চড়ে শৈশবে ফেরার অপচেষ্টা। শন শন বাতাস বইছে, আমরাও হেঁটে চলছি। অভি ভাই এমন দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে ভুল করলেন না। বিকেলে ক্যাম্পিং করব মনোস্থির করে কুকরি-মুকরি বাজারে ফিরে গেলাম দুপুরের খাবার খেতে। বিকেলে ঝিকঝাক ওয়াকওয়ে, জিপ ট্র্যাকিং, ঝুলন্ত ব্রিজ ও মাকড়সার জাল দেখা শেষে সন্ধ্যায় নারিকেল বাগানে ক্যাম্পিং করলাম। খানিকটা সন্ধ্যা হতেই চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। শিয়ালের বিকট শব্দে ডাকাডাকি, সঙ্গে হরিণ ও বিভিন্ন পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে। তাঁবু থেকে উঁকি মেরে চাঁদটা দেখছি, আহ! কী সে অনুভূতি। উল্লেখ্য, চর কুকরি-মুকরি, তারুয়া এবং ঢালচরে গ্রামীণ সিমকার্ড ছাড়া অন্য কোনো অপারেটরের সিমে নেটওয়ার্ক সাধারণত পাওয়া যায় না।
বিপুলসংখ্যক পর্যটকের চাপ না থাকার কারণে এখানকার জীববৈচিত্র্য এখনও ততটা হুমকির মুখে পড়েনি। চর কুকরি-মুকরি ও তারুয়া সমুদ্রসৈকত নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার আরও গবেষণা প্রয়োজন। তাহলে হয়তো চর কুকরি-মুকরি ও তারুয়া সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ এবং আকৃষ্ট হবে পর্যটক। পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা আরও বিকশিত হবে এবং সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি।
যেভাবে যাবেন
সড়ক পথের তুলনায় নৌপথে যাতায়াত সহজ ও উপভোগ্য। ঢাকার সদরদঘাট থেকে বেতুয়াগামী লঞ্চ সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে ছেড়ে যায়। যেসব লঞ্চে যাওয়া যাবেÑ এমভি তাশরিফ-৩, এমভি ফারহান-৫ এবং এমভি কর্ণফুলী-১৩ ইত্যাদি। বেতুয়া লঞ্চঘাটে নেমে অটোতে করে যেতে হবে চরফ্যাসন সদরে। তারপর বাস অথবা অটোতে দক্ষিণ চর আইচা। সেখান থেকে কচ্চপিয়া ট্রলার ঘাট। এরপর চর কুকরি-মুকরিতে যাওয়ার জন্য ট্রলার, লঞ্চ বা স্পিডবোটে চর কুকরি-মুকরির ১ নম্বর ঘাটে যেতে হবে। তারপর ইজিবাইক অথবা মোটরসাইকেলে চর কুকরি-মুকরি বাজার হয়ে যেতে হবে তালতলা (ইদ্রিসের দোকান)। ১০ মিনিট হেঁটে দেখা যাবে ঝিকঝাক ওয়াকওয়ে, জিপ ট্র্যাকিং, ঝুলন্ত ব্রিজ ও মাকড়সার জাল। তারপর আবারও তালতলা এসে কেওড়া বনের ভেতর দিয়ে ২০-২৫ মিনিট হাঁটলে দেখা মিলবে চর কুকরি-মুকরির ওয়াচ টাওয়ার। এরপর ছোট নৌকায় খাল পার হয়ে যেতে হবে নারিকেল বাগান। শব্দহীন এক সমুদ্রসৈকত রয়েছে- রেস্টিং বেঞ্চ, দোলনা ও ক্যাম্পিং করে থাকার সুযোগ। তারুয়া যাওয়ার জন্য ডাকাইত্তার খাল থেকে ট্রলার রিজার্ভ করতে হয়।
যেখানে থাকবেন
চর কুকরি-মুকরিতে পর্যটকরা থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল পেয়ে যাবেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এখানে গড়ে উঠেছে একটি রেস্ট হাউস। তা ছাড়া এনজিও সংস্থার অধীনে চালু হয়েছে হোম-স্টে সার্ভিস। যেখানে কম খরচে পর্যটকরা রাতযাপন করতে পারবেন। কুকরি-মুকরি বাজারেও কম খরচে থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। তারুয়া সৈকতেও পর্যটকদের থাকার জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। চাইলে আগে ফোন দিয়েও বুকিং দিতে পারবেন। হোটেল কুকরি-মুকরি : ০১৭৪৬-৭৬৫৯৫৯, তারুয়া রয়েছে ‘সোনিয়া রিসোর্ট’ যোগাযোগ :০১৭৩৫-২৫৪১৮০ (হাসান)। ক্যাম্পিংয়ের জন্য যোগাযোগ : ০১৭৫৯-৫২০৩৫৭ (নাজিম)
সমগ্র চর ঘুওে দেখার জন্য মোটরসাইকেল নিতে পারেন। চাইলে গাইডের সহায়তাও নিতে পারেন। গাইড মো. নুরু (০১৩০৩-২৪৫২৪৪)।
ছবি : লেখক