Logo
Logo
×

ভ্রমণ ও পর্যটন

চলনবিলের জনপদে একদিন

Icon

হাবিব ওয়াহিদ

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৩ পিএম

চলনবিলের জনপদে একদিন

তাড়াশ জমিদার বাড়ি। ছবি : লেখক

কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার বিচিত্র রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন একান্ত নিজস্ব দর্পণে। প্রকৃতির রং দিয়ে সাজিয়েছেন কাব্যের অমর পঙ্‌ক্তিমালা। লিখেছেন, ‘চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি– শাদা শাঁখা– বাংলার ঘাস/ আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ– আপনার মনে।’ প্রকৃতির রূপ, রস, আলো, ছায়ার নির্জনতায় খুঁজেছেন জীবনের অর্থ। ভ্রমণ নিয়ে আগ্রহ বেশ আগে থেকেই। ৬৪ জেলা ভ্রমণের ধারাবাহিকতায় এবারের ভ্রমণ গন্তব্য পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা। ভ্রমণসঙ্গী সহকর্মী মেহেদী হাসান কলি ভাই।

এবারের ভ্রমণ নিয়ে আগ্রহ কিছুটা আলাদা। দুই চাকার বাহনে ভ্রমণের নিমিত্তে আমাদের মোটরসাইকেল এগিয়ে চলছে ব্যস্ত শহরের বুক চিরে। চিরচেনা শহরের যানজট পেরিয়ে আরিচা নৌবন্দরে পৌঁছলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। ফেরি এগিয়ে চলছে। দীর্ঘ ১৯ বছর পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু হয়েছে। এর আগে নাব্য সংকটের কারণে ২০০২ সালে ফেরিঘাট আরিচা থেকে পাটুরিয়ায় স্থানান্তর করা হলে এই রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পৌনে ২ ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছলাম কাজিরহাট। মহাসড়কের পাশের টং দোকানে স্ন্যাকস বিরতি দিয়ে আবারও ছুটে চলা। রাত ১২টায় পাবনা শহরে পৌঁছে ভূরিভোজ সেরে ঘুমের দেশে। 

তাড়াশ ভবন, পাবনা

তাঁতশিল্পসমৃদ্ধ পাবনা জেলা রাজশাহী বিভাগের একটি জেলা। লোকসংগীত, লোকগাথা, লোকনৃত্য, নকশা, পালাগান ইত্যাদি লোকসংস্কৃতিতে ঐতিহ্যমণ্ডিত এ জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, জোড় বাংলা মন্দির, তাঁতীবন্দ জমিদার বাড়ি, লালনশাহ সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চাটমোহর শাহি মসজিদ, গাজনার বিল, পাকশী রিসোর্ট, ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প, তাড়াশ জমিদার ভবন ইত্যাদি। সিরাজগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে যমুনা সেতু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারিবাড়ি, উল্লাপাড়ার নবরত্ন মন্দির, ইলিওট ব্রিজ, চায়না বাঁধ, আল আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ ইত্যাদি। সাত সকালে বেরিয়ে পড়লাম তাড়াশ ভবন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, লালন শাহ সেতু ও ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে। এর পর নাটোর হয়ে চলনবিলের দিগন্তবিস্তৃত অবারিত সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছি সিরাজগঞ্জের পথে। দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল। এটি নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলাজুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ৪৭টি নদী ও খাল। বর্ষায় চলনবিল পানিতে টইটম্বুর থাকায় তৈরি হয় নয়নাভিরাম দৃশ্যের। এসব উপভোগ করতে বিলের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করেন। নবরত্ন মন্দির, চায়না বাঁধ ও বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ দেখে ঢাকার পথে আমাদের বাইক চলতে শুরু করল ...।

শহীদ হাবিবুর রহমান স্মৃতিস্তম্ভ, সিরাজগঞ্জ

তাড়াশ ভবন

বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্গত তাড়াশ উপজেলার প্রায় ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দেবচাড়িয়া গ্রামে বাসুদেব ওরফে নারায়ণ দেব চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি নবাব ইসলাম খাঁর অধীনে চাকরি করতেন। নবাব তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে চৌধুরাই তাড়াশ অঞ্চল তাঁকে জায়গির দান করেন। তৎকালে ‘পরগনা কাটার মহল্লা’ থেকে ২০০ মৌজা নিয়ে এ চৌধুরাই তাড়াশ জমিদারি সৃষ্টি হয়। আঠারো শতকে নারায়ণ দেব চৌধুরীর বংশধর বনমালী রায়কে জনহিতকর কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার রায় বাহাদুর উপাধি দেয়। তিনিই পাবনা জেলার সদর উপজেলার গোপালপুর মৌজায় তাড়াশ ভবনটি নির্মাণ করেন। এ ভবনটি তাড়াশের রাজবাড়ী নামেও পরিচিত। ভবনটি ১.৫৯৭৫ একর ভূমির ওপর নির্মিত।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে ২.৪ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্পটি পদ্মা নদীর ওপরে নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর পাশেই নদীতীরে অবস্থিত। 

লালন শাহ সেতু

লালন শাহ সেতু পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত একটি সেতু। ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নে অবস্থিত। কুষ্টিয়ার বিখ্যাত বাউল সম্রাট লালন শাহের নামে এ সেতুর নামকরণ করা হয়েছে। সেতুটি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশেই অবস্থিত। সেতুটির পূর্ব পাশে ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী এবং পশ্চিম পাশে ভেড়ামারা উপজেলা অবস্থিত। সেতুটি তৈরির ফলে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ জেলার লোকদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

শৈল্পিক কারুকার্যে খচিত বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক লাল রঙা এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১০০ বছর পেরিয়ে এখনও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে চলেছে। এ ছাড়া ব্রিজটির ঠিক পাশ দিয়েই ২০০৪ সালে তৈরি করা হয়েছে একটি সড়ক সেতু, যা কুষ্টিয়া জেলার বিখ্যাত সাধক ফকির লালন শাহের নামানুসারে লালন শাহ সেতু নামে পরিচিত, যা পদ্মার বুকের ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সঙ্গে এক অপরূপ সৌন্দর্যে মিলেমিশে রয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম সেতুবন্ধ তৈরি করেছে ঐতিহাসিক এই ব্রিজটি। এ রেল সেতুটি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী থেকে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা পর্যন্ত সংযুক্ত করেছে।

নবরত্ন মন্দির

সিরাজগঞ্জে কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে নবরত্ন মন্দির। প্রায় ৬০০ বছরের পুরোনো প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুলের এই নবরত্ন মন্দির। আনুমানিক ১৭০৪-১৭২৮ সালের মধ্যে নবাব মুর্শিদকুলি খানের শাসনামলে রামনাথ নামক জমিদার মতান্তরে তহশিলদার এ মন্দির নির্মাণ করেন। বাংলাদেশে প্রাচীন যেসব হিন্দু মন্দির দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলোর অন্যতম একটি এই হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির। রামনাথ ভাদুরী দিনাজপুরের কান্তজি মন্দিরের মতোই এখানে একটি মন্দির তৈরি করেন। 

আল আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ

দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলী দ্বারা নির্মিত ‘আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ’। সিরাজগঞ্জ-এনায়েতপুর সড়কের বেলকুচি পৌর সদরে গেলেই চোখ আটকে যাবে দৃষ্টিনন্দন এক স্থাপনায়। অপরূপ সৌন্দর্যের নজরকাড়া নিদর্শন আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ। প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মসজিদটি দেশজুড়ে বহু মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে।

  • ভ্রমণবিষয়ক লেখক

ঢাকা টুডের একটি প্রকাশনা

অনুসরণ করুন