ইসলাম
এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বিষয়ক শরঈ বিধান প্রসঙ্গে
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৬ পিএম
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণকে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বলে। মানব শিশু ইউটেরাস বা গর্ভাশয়ে বেড়ে উঠে। স্পাম ও অভাম গর্ভাশয়ে পৌঁছানোর পূর্বে কিছু স্তর অতিক্রম করে।
প্রথম কয়েক ঘন্টার মাঝে ফ্যালোপিয়ান টিউব (যা ইউটেরাসের সঙ্গে যুক্ত লম্বা টিউব, তাকে ইউটেরাইন টিউবও বলা হয়)-এ ফার্জিলাইজেশন/নিষিক্ত হয়। ফার্টিলাইজেশন পরবর্তী হিউম্যান ভ্রুণকে জাইগোট/কোষ বলা হয়। নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়ায় প্রথমে একটি জাইগোট থাকে। তা থেকে ২৪-৩০ ঘন্টার মাঝে সেল ডিভিশন শুরু হয় এবং ২-৩ দিনের মাঝে ২/৪/৮ হারে সেলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এ প্রক্রিয়াকে ‘ক্লিভেজ’ বলা হয়। তারপর ৩-৪ দিনের মাঝে ১৬-৩২ সেলে পরিণত হয় যা দেখতে একটি বলের মতো। তাকে ‘’মরুলা’/কোষপূঞ্জ বলা হয়। ইউটেরাইন টিউবের সিলিয়া মৃদু ধাক্কা দিয়ে তাকে ইউটেরাসে পৌঁছে দেয়। মরুলা বিভাজিত হয়ে ইউরেটাসে ‘ব্লাস্টুলা’ পরিণত হয়। তারপর ৪-৫ দিবসে তা পরিণত হয় ১২৮ কোষের সমন্বয়ে গঠিত এবং অবিচ্ছিন্ন কোষবিশিষ্ট একক স্তরযুক্ত ফাঁকা আকৃতির মানব ভ্রুণে। তারপর ৬-১০ দিবসে ইউটেরাইন ওয়ালের সাথে পিণ্ড হয়ে ঝুলে ক্রমে বৃদ্ধি পায় যাকে ইমপ্ল্যান্টেশন/গর্ভধারণ বলা হয়। ইউরেটাসে না পৌঁছে যদি টিউবে ডিম্বাণু বৃদ্ধি হয়, তাহলে তা ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এ ধরনের প্রেগন্যান্সিকে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বলা হয়। এ প্রকৃতির ভ্রুণ রক্ষা অসম্ভব এবং তা গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতের কারণ হয়। ফলে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা শুরুতেই করা অত্যাবশ্যক।
পবিত্র কুরআনের ভাষ্য
চিকিৎসকের এ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ও সমস্যা সমাধানে শরীআর দিক বিবেচনায় পবিত্র কুরআনের কিছু ভাষ্য পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
এক. আল্লাহ তা‘আলা একটি মানব শিশুর বিকাশের প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন স্তরে পরিপূর্ণতা প্রদান করেন। তিনি বলেন, “তিনি তোমাদেরকে বিভিন্ন স্তর থেকে সৃষ্টি করেছেন।” [আল-কুরআন, ৭১:১৪]
দুই. পবিত্র কুর’আন ভ্রুণ বিকাশের পর্যায়গুলো বিভিন্ন সূরায় খন্ডভাবে এবং সূরা মু’মিনুনে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। তম্মধ্যে ভ্রুণ বৃদ্ধির নির্দিষ্ট স্থান নির্দেশ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আমি নুৎফা (স্পার্ম-ওভাম) রূপে একটি সুরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। আমি জাইগোটকে ‘আলাক’/ঝুলন্ত টুকরোতে পরিণত করি। ‘আলাক’কে পিণ্ডে পরিণত করি এবং পিণ্ডকে অস্থি পঞ্জরে পরিণত করি; অস্থি পঞ্জরকে গোশত দ্বারা ঢেকে দেই; অবশেষে তাকে অন্য এক সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি। সুতরাং তিনি আল্লাহ তা‘আলা যিনি সর্বময় স্রষ্টা।” [আল-কুরআন, ২৩:১৩-১৪]
আরবী ‘নুৎফা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে স্বল্প পরিমাণ পানি যা এক ফোটা কিংবা কয়েক ফোটার সমান। কোন একটি বালতি বা পাত্রে অযূ বা গোসলের পর অবশিষ্ট থেকে যাওয়া পরিচ্ছন্ন স্বল্প পরিমাণ পানিকে নুৎফা বলা হয়। মুক্তাদানাকেও নুৎফা বলা হয় কেননা তা দেখতে অনেকটা স্বচ্ছ পানির ফোটার মত। কোন কোন ব্যক্তিকেও তার বদান্যতা ও শুভকাজের জন্যে আন-নুৎফ বা মুনতিফ বলা হয়। কেননা সে সবসময় ধারাবাহিকভাবে কল্যাণমূলক কাজ করেন। পবিত্র কুরআন আন নুৎফা শব্দটি নারী ও পুরুষ উভয়ের অতি সুক্ষ জনন কোষ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
তিন. ভ্রুণে বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় স্পার্ম ও অভামের নিষেকের প্রক্রিয়াকে পবিত্র কুরআনে ‘নুৎফাতুন-আমসাজ’ বা ‘নিষিক্ত কোষ’ বলা হয়েছে। [আল-কুরআন, ৭৬:২]
এটাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় জাইগোট বলা হয়। শুক্রবিন্দু ও ডিম্বাণুর মিলনের পরবর্তী ঘটনা হচ্ছে ‘নুৎফাতুন-আমসাজ’ বা ফার্টিলাইজেশন অর্থাৎ এমন এক ‘নিষিক্ত কোষ’ যা সাধারণত ইউটেরাইন টিউবের বহির্দেশে ঘটে থাকে।
চার. ভ্রুণের বিকাশের জন্য আল্লাহ তাআলা উপযুক্ত স্থানে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “অতপর আমি তা রেখেছি নিরাপদ আধারে, এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত। অতপর আমি একে গঠন করেছি পরিমিতভাবে, আমি কত নিপুণ স্রষ্টা।” [আল-কুরআন, ৭৭:২২-২৪]
পাঁচ. মাতৃগর্ভে ভ্রুণের বিকাশ ও মানব শিশুর পরিপূর্ণ পরিগঠনের নির্দিষ্ট স্থান ‘রেহেম’ বা জরায়ু। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছে তোমাদের আকৃতি গঠন করেন।“ [আল-কুরআন, ৩:৬] “প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং গর্ভাশয়ে যা কিছু কমে ও বাড়ে আল্লাহ তা জানেন এবং তার নিকট প্রত্যেক বস্তুরই এক নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে।“ [আল-কুরআন, ১৩:৮] “আমার ইচ্ছা অনুযায়ী তা এক নির্দিষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে স্থিত রাখি“। [আল-কুরআন, ২২:৫]
হাদীসের ভাষ্য
সহীহ হাদীসসমূহেও গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের এই সকল সৃষ্টি-পর্যায়ের কথা উল্লেখ হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টি (অর্থাৎ তার মূল উপাদান প্রথমে) ৪০ দিন তার মাতার গর্ভে নুৎফারূপে থাকে। অতঃপর ৪০ দিন লাল জমাট রক্ত পিন্ডরূপে অবস্থান করে, তৎপর ৪০ দিনে গোশত পিন্ডরূপ ধারণ করে। অতঃপর আল্লাহ তার নিকট এক ফিরিশতা পাঠিয়ে তার রূহ ফুঁকা হয়---।’’ [বুখারী] অর্থাৎ, চার মাস পর ভ্রূণে আত্মাদান করা হয় এবং তা পরিপূর্ণ মানবাকৃতিতে বিকাশ লাভ করে।
ইসলামী পণ্ডিতের অভিজ্ঞতা
ইবন হাজার ‘আসকালানী বলেছেন, শুক্র গর্ভে প্রবেশ করার পর গর্ভের সাথে সংযুক্ত হওয়ার পূর্বে ছয় দিন থাকে। তিনি ইবন কাইয়েম আল-জাওযিয়্যাহ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলেন, শুক্র গর্ভে প্রবেশ করে একটি বল সদৃশ আকৃতি গ্রহণ করে এবং এটা নিজে নিজে গর্ভে সংযুক্ত হবার পূর্বে ছয় দিন থাকে। ড. জগলুল নাজ্জার তাঁর তাফসীরুল আয়াতিল কাওনিয়্যাহ গ্রন্থে বলেন, “নিষিক্ত হওয়ার পর পনেরতম দিনের মাঝে নুতফা আমশাজ বা মিশ্রিত তরল জরায়ুর সাথে বিভাজিত ঝুলন্ত অবস্থায় গাঠনিক রূপ পেতে শুরু করে। এ গঠনের দু’টি রূপ। একটি বর্হিস্ত স্তর ও অন্যটি আভ্যন্তরীণ স্তর। এখানে মধ্য স্তরে ক্রমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিগঠিত হতে শুরু করে।
পবিত্র কুর’আন, হাদীস ও ইসলামী পণ্ডিতদের অভিজ্ঞতা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নারী-পুরুষের নুৎফাদ্বয়ের মিলনে কোষের গঠিত হওয়া সম্পর্কে এ মূল্যবান বৈজ্ঞানিক অভিব্যক্তি প্রদানের ক্ষেত্রে পবিত্র কুর’আনই অগ্রপথিক।
উপরোক্ত বিশ্লেষণ এ সিদ্ধান্ত প্রদান করে যে, আল্লাহ তাআলা ভ্রুণ বিকাশের উপযুক্ত স্থান নির্ধারিত করেছেন ইউরেটাসকে। ফ্যালোপিয়ান কিংবা ইউটেরাইন টিউবে ভ্রুণের ফার্টিলাইজেশন এবং মরুলা পরবর্তী বিকাশ অনাকাঙ্ক্ষিত। এমতাবস্থায় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে অনাকাঙ্ক্ষিত ভ্রুণ অপসারণ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নবীজি (সা.) কর্তৃক ‘হিজামা’ চিকিৎসা নীতি তুলনীয়।
"জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা নবীজি (সা.) সাহাবী উবাই ইবন কা’বের নিকট এমন একজন চিকিৎসক প্রেরণ করেন, যিনি তাঁর একটি শিরা কেটে রক্ত-মোক্ষণ করেন।"
[আবু দাউদ, আস-সুনান, ৩৮২৩] ইবন হাজার আল-আসকালানী (র.) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, খুনসাদের নারীসুলভ উপাত্ত অপারেশনের মাধ্যমে বর্জন করা বৈধ। [ইবন হাজার, ফাতকূল-বারী, রিয়াদ: দারুস-সালাম, ১৯৯৭, খ. ১০, পৃ. ১৯২] এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতামতের ভিত্তিতে উক্তরূপ সিদ্ধান্ত প্রয়োগযোগ্য। আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১১০০