রংপুরে জনসচেতনতামূলক র্যালিতে সিসা দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের দাবি
গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:৫২ পিএম
‘সিসা দূষণ বন্ধ হলে, বাড়বে শিশু বুদ্ধি-বলে’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক সিসা দূষণ প্রতিরোধ সপ্তাহ (২০-২৬ অক্টোবর) উপলক্ষে ইয়ুথনেট গ্লোবাল এবং পিওর আর্থ বাংলাদেশ যৌথভাবে রংপুর জেলায় আজ (২০ অক্টোবর) জনসচেতনতামূলক র্যালি, মানববন্ধন ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। যা অনুষ্ঠিত হয় ইউনিসেফ-এর সহায়তায়।
র্যালিতে অংশগ্রহণকারীরা সরকার ও নীতিনির্ধারকদের প্রতি পাঁচটি মূল দাবি তুলে ধরেন। এগুলো ছিল- ভোগ্যপণ্য ও নিত্য ব্যবহার্য পণ্য যেমন অ্যালুমিনিয়ামের রান্নার বাসনপত্র, দেয়াল রং, শিশুদের খেলনা ইত্যাদিতে ক্ষতিকারক ভারী ধাতু সিসা মেশানো বন্ধ করতে বিভিন্ন জিনিসের নিরাপদ মানদণ্ড ও কঠোর মনিটরিং নিশ্চিত করা, দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা অনিরাপদ সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি কারখানাগুলো বন্ধ করে বা রূপান্তরিত করে নিরাপদ ও পরিকল্পিত রিসাইক্লিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, অবৈধ সিসা ব্যাটারি কারখানার কারণে দূষিত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সিসা দূষিত অঞ্চলগুলো পরিষ্কার করা, সিসা দূষণ প্রতিরোধে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালাগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা এবং আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা, এবং সকল অংশীদ্বারদের সাথে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সিসা দূষণের উৎস ও ভয়াবতা সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষা করা।
র্যালিতে ৫০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি অংশ নেন যাদের মধ্যে ছিলেন ইয়ুথনেট গ্লোবালের স্বেচ্ছাসেবীরা, পিওর আর্থ বাংলাদেশ ও ইউনিসেফের প্রতিনিধিবৃন্দ, সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন যুব সংগঠন, সুশীল সমাজ সংগঠন ও স্থানীয় এনজিও প্রতিনিধি, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, নীতিনির্ধারণী মহল, পরিবেশ অধিকারকর্মী, সমাজকর্মী, গণমাধ্যমকর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ। র্যালিটি সকাল ১১টায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে মানববন্ধন তৈরির মাধ্যমে দুপুর ১২টায় শেষ হয়। এসময় সবার হাতে ছিল সিসা দূষণ প্রতিরোধমূলক ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড এবং মুখরিত ছিল “সিসা দূষণ প্রতিরোধে, আমরা আছি একসাথে”- সহ বিভিন্ন স্লোগানে। সিসার বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করতে সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ানো এবং সরকার ও নীতিনির্ধারণী মহলকে এবিষয়ে আইন ও নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ করে কঠোর ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে জোর দেওয়া ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। এসময় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সিসা দূষণ বিষয়ক লিফলেট ও স্টিকার বিতরণ করা হয়।
এসময় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে সিসা দূষণের বিস্তৃতি ভয়াবহ পর্যায়ে থাকা সত্ত্বেও এর প্রভাব ও উৎস নিয়ে সাধারণ জনগণ ও নীতিনির্ধারণী মহলে সচেতনতা খুবই সীমিত। যার ফলে, বিশ্বে সর্বোচ্চ সিসা দূষিত দেশের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের মানুষদের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু অর্থাৎ দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশুর রক্তে উচ্চ মাত্রায় সিসা আছে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সিসা দূষণের কারণে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (সিভিডি) বা হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে যার ফলে বছরে প্রায় ১৪০,০০০ মানুষ মারা যাচ্ছে।
গর্ভবতী নারীদের রক্তে সিসার উপস্থিতি গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসবসহ নানা ঝুঁকির সৃষ্টি করে। বুদ্ধিমত্তা হ্রাস ও হৃদরোগে মৃত্যুর ফলে দেশের আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ২৮,৬৩৩ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার, যার কারণে দেশে বছরে ৬ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি ঘাটতি হয়। এধরনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে আন্তর্জাতিক সিসা দূষণ প্রতিরোধ সপ্তাহ ২০২৪ চলাকালীন জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সরকার ও জনসাধারণের কাছে সিসা দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশদের রক্ষা করার জন্য জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
ইউনিসেফের সোশ্যাল অ্যান্ড বিহেভিওরাল চেঞ্জ অফিসার, মনজুর আহমেদ বলেন, ইউনিসেফ গত বছর সিসা দূষণ প্রতিরোধে একটি গাইডলাইন তৈরি করেছে এবং সেই সাথে পিওর আর্থের মত উন্নয়ন সংস্থার সাথে কাজ করছে তিনটি উদ্দেশ্যে – সিসা দূষণ প্রতিরোধে দক্ষতা বৃদ্ধি, গণসচেতনতা এবং অ্যাডভোকেসিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা। তরুণরা হলো চেঞ্জ এজেন্ট। সিসা দূষণের মত গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে তাদের সম্পৃত্ততা প্রয়োজন।
র্যালি ও মানববন্ধন শেষে যুবসমাজকে সিসা দূষণ প্রতিরোধ কার্যক্রমে যুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করে পিওর আর্থ বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. মাহফুজার রহমান বলেন, "যুব সমাজ হলো আগামী ভবিষ্যৎকে সুন্দর করে গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর। যুব সমাজকে পরিকল্পিতভাবে সিসা দূষণ প্রতিরোধে যুক্ত করতে হবে কেননা তাদের মধ্যে আছে নিজের পরিবার, কমিউনিটি, সংগঠন বা ক্লাব, সহকর্মীসহ চারপাশের মানুষের উপকার ও মঙ্গল সাধনের মনোভাব যা টেকসই পরিবর্তন আনতে ফলপ্রসূ ও গঠনমূলক অবদান রাখতে পারে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা একটি সিসামুক্ত নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবো।
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, এই লড়াই হলো নীরব ঘাতক সিসা দূষণকে নির্মূল করে আমাদের শিশুদের জন্য সুস্বাস্থ্য ও সিসামুক্ত নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার। মানুষকে সচেতন করার এবং কার্যকরী উদ্যোগ নেয়ার এখনই সময়। আমরা যুব সমাজের প্রতিনিধিরা সবাই একসাথে আওয়াজ তুলছি, দাবি জানাচ্ছি - সিসা-মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার।